জীবিকার খোঁজে দুই যুগ আগে সৌদি আরব পাড়ি দেন মোহাম্মদ আল হেলাল। সেখান থেকে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় তাঁকে দেওয়া হয় ‘সিআইপি’ উপাধি। সেখানে রাজনৈতিক পরিচয় কাজে লাগান হেলাল। এর পর উদ্যোক্তা হওয়ার কথা বলে শুরু করেন প্রতারণা। তাঁর প্রতারণার শিকার সৌদি আরব, ইয়েমেন, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও বাংলাদেশিরা। সৌদি নাগরিক প্রতারণার অভিযোগ তোলার পর পালিয়ে দেশে চলে এসেও চালিয়ে যান প্রতারণা। চট্টগ্রামে খুলে বসেন ‘চট্টগ্রাম প্রবাসী ক্লাব লিমিটিড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সেখান থেকেও কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
আল হেলালের ৩২ কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য পাওয়া গেছে। সৌদিতে চুক্তিপত্র ছাড়াই অর্থ লেনদেনের সুযোগও কাজে লাগিয়েছেন তিনি। তাঁর হাতিয়ে নেওয়া অর্থের পরিমাণ আরও বেশি হবে বলে ধারণা প্রবাসী ভুক্তভোগীদের।
২০০১ সালে প্রথম সৌদিতে যান তিনি। সৌদির হাইল শহরের ইনভেস্টর (বিনিয়োগকারী) ভিসা নেন ২০০৯ সালে। বিনিয়োগের শর্ত পূরণ করতে না পেরে আবারও সাধারণ ভিসা নেন। সেই ভিসার তথ্য অনুযায়ী, আল হেলাল এখনও সৌদিতে অবস্থান করছেন। তবে সৌদিতে হেলালের নামে প্রতারণার মামলা হওয়ার পর পাসপোর্ট জব্দ করে দেশটির সরকার। পরে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশী কোনো দেশে পালিয়ে যান। এর পর ২০২০ সাল থেকে দেশেই অবস্থান করছেন।
সৌদি আরবপ্রবাসী সৈয়দ আহমেদ ভূঁইয়া সমকালকে বলেন, হেলাল ২০০৪ সালে মক্কা ও জেদ্দা শহরে বিএনপির সভাপতি ছিলেন। ওই বছরই তিনি সিআইপি উপাধি পান। মূলত এই দুটি পরিচয় তাঁকে প্রবাসীদের কাছে পরিচিত করে তোলে। পরে সিআইপি খেতাব কাজে লাগিয়ে সৌদিসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্যের কয়েক হাজার প্রবাসীর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
হেলালের প্রতারণার শিকার প্রবাসীদের একজন মো. আফছার। তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালে মক্কার আবরাজ আল বাইত ক্লক টাওয়ারের নিচতলায় শপিংমল করার জন্য জায়গা ভাড়া নেন হেলাল। সে সময় শপিংমলের কাজ করার জন্য ১৮ লাখ রিয়াল (সাড়ে ৫ কোটি টাকা) দিয়েছি। মাসখানেক দেশে থেকে সৌদি ফিরে শুনি, হেলাল ব্যবসা গুটিয়েছেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাঁর সন্ধান পাইনি। ২০২০ সালে ফেসবুক ও বিভিন্নজনের মাধ্যমে জানতে পারি হেলাল বাংলাদেশে। ২০২২ সালের ৩ অক্টোবর সৌদি আরবের জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটে অভিযোগ করি। তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেন।’
আফছার বলেন, ‘চলতি বছরের ৩০ আগস্ট হেলাল চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে আমার নামে মিথ্যা মামলা করেন। এজহারে বলা হয়েছে, তাঁর কাছ থেকে ৪০ লাখ রিয়াল নিয়ে আত্মসাৎ করেছি।’ এ বিষয়ে পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা মুজাম্মেল হক বলেন, মামলার বাদী ও বিবাদীর মধ্যে ব্যবসায়িক চুক্তি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। প্রবাসী আফছারের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের কথা বললে উল্টো তাঁর কাছে থেকেই টাকা পাওয়ার দাবি করেন হেলাল। তিনি বলেন, আইনি প্রতিকার পেতে চট্টগ্রাম আদালতে আফছারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। একটি সূত্র জানায়, একজন সৌদি নাগরিক সে দেশের অপরাধ আদালতে হেলালের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
ভিনদেশি ভুক্তভোগীদের আকুতি
ভুক্তভোগী সৌদি নাগরিক আবদুল হাদি এক ভিডিও বার্তায় জানান, ২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মক্কা ক্লক টাওয়ারে হেলাল ২২টি দোকান ও একটি কফিশপ ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। সেখানে ২৫ লাখ ৭ হাজার ৭৭১ রিয়ালের বিনিময়ে তাঁকে অংশীদার করেন। কিন্তু ব্যবসার কথা বলে অর্থ নিয়ে তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভারতের নাগরিক ওয়ান সাইদ মুজাহির বলেন, ‘হেলালের কাছ থেকে দোকান ভাড়া নেওয়ার জন্য ৬৫ হাজার রিয়াল দিয়েছিলাম। কিন্তু দোকান দেয়নি। আবার রিয়ালও ফেরত দিচ্ছে না।’ পাকিস্তানের নাগরিক সিদ্দিক সওদাগর ভিডিও বার্তায় হেলালের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি অনেক কষ্টে অর্থ উপার্জন করেছি। তোমার দেশে (বাংলাদেশে) গিয়ে মামলা করার মতো অবস্থাও আমার নেই।’
তবে প্রতারণার বিষয় অস্বীকার করে হেলাল সমকালকে বলেন, সৌদিতে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু দেশে ফিরে আসার বিষয়ে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
অভিযোগ উঠেছে হেলাল এক সৌদি নাগরিকের ৭ কোটি ৮৩ লাখ, প্রবাসী আফছারের ৫ কোটি ৮৭ লাখ ৯০ হাজার, মিয়ানমারের এক নাগরিকের দেড় কোটি, ভারতীয় নাগরিক সাইদের ৫ কোটি ৮৭ লাখ ৯০ হাজার, অন্য আরেকজনের কাছ থেকে এক কোটি, চট্টগ্রাম প্রবাসী ক্লাবের ৮ কোটি ও প্রবাসী ক্লাবের অনিবন্ধিত ৬ হাজার সদস্যের কাছ থেকে ৩ কোটি টাকা নিয়েছেন। এর বাইরে মৌখিক চুক্তির মাধ্যমেও টাকা নিয়েছেন তিনি।
প্রবাসী ক্লাবের নামে প্রতারণা
চট্টগ্রামে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর থেকে ‘চট্টগ্রাম প্রবাসী ক্লাব লিমিটেড’ নামে ২০২০ সালে নিবন্ধন নেওয়া হয়। ক্লাবের মেমোরেন্ডামে দেখা যায়, মালিকানায় ১২ জনের নাম। তারা সবাই হেলালের আত্মীয়স্বজন। এই ক্লাবের সদস্য প্রায় ১৩ হাজার, তারা সবাই প্রবাসী। ক্লাবে চার শ্রেণির সদস্য নেওয়া হয়। এর মধ্যে থ্রি ডায়মন্ড, টু ডায়মন্ড, ডায়মন্ড ও সাধারণ সদস্যরা মাসিক এবং এককালীন চাঁদা দেন। চাঁদার পরিমাণ ১ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত। ক্লাবের নামে প্রবাসীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ চাঁদা আদায় করে সম্পদ গড়ার কথা বলা হলেও সদস্যদের কিছুই নেই। সমকালের হাতে আসা ক্লাবের আয় ও ব্যয়ের কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রবাসী ক্লাবের আয় ২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা হলেও ব্যাংক হিসাব নম্বরে আছে মাত্র ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এই আয় দেখানো হয় নিবন্ধিত মাত্র ৫ হাজার সদস্যের, আরও ৮ হাজার সদস্যের আর্থিক লেনদেনের কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।
প্রবাসী ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জেদ্দাপ্রবাসী মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, হেলাল প্রবাসীদের টাকায় নিজের নামে সম্পদ করেছেন। ৩-৪ কোটি টাকার কোনো হিসাব নেই। ক্লাবের অর্থ সম্পাদক মালয়েশিয়া প্রবাসী সাহাদৎ হোসেন বলেন, প্রবাসীদের বলা হচ্ছে– ক্লাবের সম্পদ আছে, কিন্তু কাগজে-কলমে কিছু নেই। চট্টগ্রাম ক্লাবের নামে চাঁদা তুলে আত্মসাতের বিষয়ে হেলাল বলেন, সবাইকে নিয়ে কাজ করলে তো অভিযোগ থাকবেই।