ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সব ধরনের দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে (প্রথম আলো, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
সিদ্ধান্তটি আসলে যুগান্তরকারী বলে আমি মনে করি। কেন? ভারতের যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বখ্যাত সেগুলো হলো ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সাইন্স (র্যাঙ্কিং ২০০-২১১), ২৩টি আইআইটি! এইসব সেরা প্রতিষ্ঠানে স্টুডেন্ট পলিটিক্স নেই বললেই চলে।
তাবে কি ওখানকার শিক্ষার্থীরা রাজনীতির খবর রাখে না? রাজনীতি চর্চা করে না? করে কিন্তু ক্যাম্পাসে একদম না। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি যেমন নেই তেমনি শিক্ষক রাজনীতিও নেই। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি প্রচণ্ড একটিভ এবং এর ফলে এরা র্যাঙ্কিং-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও পেছনে।
অথচ ভারতে উচ্চ মানের শিক্ষক ও গবেষকের অভাব নেই। ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি থাকার প্রভাব সেখানে শিক্ষক ও ভিসি নিয়োগেও পরে। শুধু যদি রাজনীতি না থাকতো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সাইন্সের মতোই হতো বলে আমার বিশ্বাস। অনেকের ধারণা, ছাত্ররাজনীতি না থাকলে ছাত্ররা নেতৃত্ব শিখবে কোথা থেকে?
ইংল্যান্ডের বড় বড় রাজনীতিবিদরা যেমন অধিকাংশ প্রধানমন্ত্রীই ক্যামব্রিজ-অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট। সেখানে তো লেজুড়বৃত্তির দলীয় রাজনীতি নেই। ছাত্র সংসদ ভিত্তিক কর্মকাণ্ড আছে যারা ছাত্রদের জন্য নানারকম ছাত্র ও শিক্ষার জন্য হিতকর কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকে।
আমরা বাংলাদেশের যেই সময়ের ছাত্ররাজনীতি নিয়ে গর্ববোধ করি সেই সময়ের ছাত্ররা লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি করতো না। তখন ক্যামব্রিজ-অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হল সংসদভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি করতো এবং তারা ছিল ক্লাসের সেরা ছাত্র।
আমরা বাংলাদেশের যেই সময়ের ছাত্ররাজনীতি নিয়ে গর্ববোধ করি সেই সময়ের ছাত্ররা লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি করতো না। তখন ক্যামব্রিজ-অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হল সংসদভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি করতো এবং তারা ছিল ক্লাসের সেরা ছাত্র।
আমার পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের অনেক শিক্ষকই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের সংসদের ভিপি/জিএস বা অন্য কোনো পদে নির্বাচিত ছিল। তখন শিক্ষার্থীরা ভালো ছাত্র না হলে তাদের ভোট দিত না।
স্বাধীনতার পর চিত্র উল্টে যায়। যেতে যেতে এখন মোটাদাগে বলা চলে ক্লাসের সবচেয়ে বখাটে বা কম পড়ুয়া ছাত্ররা ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত। ছোট ছোট কিছু ছাত্র সংগঠন আছে যারা সুস্থ ধারার রাজনীতি করে কিন্তু তারা একটু বড় সংগঠন হলে সেই বড় দলগুলোর মতোই আচরণ করতো বা করে।
৩০ বছরের ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশকে কি দিয়েছে? একজন নেতা বানিয়েছে? উত্তর না। কতজন শিক্ষার্থীর জীবন ধ্বংস করেছে অসংখ্য। এখন কি ভালো ছাত্ররা রাজনীতি করে? ২/৩ মাস আগেও মধুর ক্যান্টিনের সামনে দামি গাড়ি দেখেছি। ছাত্রাবস্থায় ছাত্ররাজনীতি করে গাড়ি-বাড়ি করে কীভাবে?
বর্তমানে রাজনীতির মাধ্যমে ছাত্র নেতারা শেখে কেন্দ্রীয় নেতাদের তোষামোদি, ছিনতাই, টর্চার করা, মবকিলিং ইত্যাদি যতরকম খারাপ কাজ আছে সেইসব। একজন প্রভোস্টের পক্ষে হল চালানো কঠিন করে ফেলে ছাত্রনেতারা। এরা প্যারালাল প্রশাসন তৈরি করে। এরা হলের ক্যান্টিনে বাকি বা ফ্রি খাওয়ার কারণে ক্যান্টিনের খাবার মান খারাপ হয়।
ছাত্ররাজনীতির একটা সুফল বলুন তো? ২০২৪ সালের ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের ছাত্ররাজনীতির কতখানি ভূমিকা আছে? যদি থাকতো অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব যারা দিয়েছে তারা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি করতো না। এই অভ্যুত্থানে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকরা। সেখানকার ছাত্ররা তো ছাত্ররাজনীতি করে না।
ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি না থাকলে শিক্ষক নিয়োগ তুলনামূলকভাবে ভালো হবে। তাতে শিক্ষা ও গবেষণার উন্নতি হবে। ছাত্ররাজনীতি না থাকলে ক্যাম্পাসে মারামারি, হানাহানি কমে যাবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে। ছাত্ররা নেতৃত্ব শিখবে হল সংসদ ও ডাকসুর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
তাহলে ছাত্ররা রাজনীতি না করলে দেশ রসাতলে যাবে বলা যাবে না। বরং ছাত্ররাজনীতি থাকার কারণে শিক্ষায় বরাদ্দ কমানো সত্ত্বেও বাজেটের পক্ষে আনন্দ মিছিল করে। শিক্ষার্থীরা যে আবাসিক হলে অমানবিক জীবন যাপন করে ছাত্র নেতারা কি এইসব বন্ধে কোনো দাবি কখনো করেছে?
এখন যে ছাত্ররাজনীতি নেই বরং এখনই ক্যাম্পাসে প্রতিদিন অসংখ্য রাজনৈতিক সভা সেমিনার হচ্ছে যেগুলোয় উপচে পড়া ভিড়। এইসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা রাজনীতি সচেতন নাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে।
ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি না থাকলে শিক্ষক নিয়োগ তুলনামূলকভাবে ভালো হবে। তাতে শিক্ষা ও গবেষণার উন্নতি হবে। ছাত্ররাজনীতি না থাকলে ক্যাম্পাসে মারামারি, হানাহানি কমে যাবে।
তাই আমি ক্যাম্পাসে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের পক্ষে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না বাকি সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা উচিত। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে দেশের অন্তত ১৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৪টি সরকারি কলেজ ও ১০টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
জনগণের ট্যাক্সের টাকায় শিক্ষকদের বেতন হয় পড়ানো ও গবেষণার জন্য। শিক্ষার্থীরা প্রায় ফ্রি পড়ার সুবিধা আসে জনগণের ট্যাক্সের টাকায়। সেটা রাজনীতি করার জন্য না। বেলুনে ছোট একটা ফোটা রাখলেই যথেষ্ট। সব বাতাস সেখান দিয়েই যাবে। এখানে ছোট ভালো সংগঠনের রাজনীতি করার জন্য সামান্য একটু জানালা খোলা রাখলে সেই জানালা দিয়েই সন্ত্রাসী বড় রাজনৈতিক দল ঢুকে যাবে। আটকাবেন কী দিয়ে? এত বছর তো আটকাতে পারিনি।
রাজনীতি করতে হলে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসেন। অন্তত ৩ বছর রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস হলে কেমন হয় একটু দেখি না। এত বছর তো ছাত্ররাজনীতি দেখলাম। আর ৩ বছর রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস দেখি। ছাত্ররাজনীতি নেই মানে ক্যাম্পাসে রাজনীতি থাকবে না এমন নয়।
রাজনৈতিক আলোচনা সভা সেমিনার চলবে। হল সংসদ, ডাকসু হবে। কেবল দলীয় রাজনীতি থাকবে না। তাই আমি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনুরোধ করব প্লিজ ক্যাম্পাসে আপনাদের বিষাক্ত রাজনীতি ইঞ্জেক্ট করা থেকে বিরত থাকুন।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: লেখাটি ঢাকা পোস্টে প্রকাশ