নির্বাচনে অনিয়ম হবে না সেটা জোর দিয়ে কখনোই বলা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
আজ সোমবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশিক্ষণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘যখনই নির্বাচনের প্রশ্ন আসে, অনেক সময় আমরা এটিকে হালকা করে নেই। আবার অনেক সময় এটাকে সিরিয়াসলি নেই কিন্তু নির্বাচন বিষয়টা কখনোই হালকা করে নেওয়ার বিষয় নয়।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ সরকার গঠন করা নয়। আমাদের কাজ খুব সীমিত—নির্বাচন আয়োজন করে সংসদ সদস্যদের নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমে যদি সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত না হন তাহলে প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই।’
সিইসি বলেন, ‘অনেকেই বলেন উনারা যদি নির্বাচনটা তিন মাস পিছিয়ে দিতেন, তাহলে ভালো হতো। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা হয়নি। প্রথমত, তিন মাস পিছিয়ে দেওয়ার কোনো রকম এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের নেই। অনেকেই একটি বিভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়েন, মনে করেন নির্বাচন কমিশন অসীম ক্ষমতার অধিকারী; প্রয়োজনে তিন মাস, তিন বছর বা ৩০ বছর পিছিয়ে দিতে পারে; এগুলো সত্য নয়।’
বাংলাদেশে নির্বাচন আজ অব্দি একটি স্থিতিশীল অবস্থানে এসে থিতু হতে পারেনি মন্তব্য করে হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় নির্বাচন দেখেছি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে; পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে না বা হয় না কিন্তু মোটামুটি যদি গ্রহণযোগ্য হয় তাহলেই সেটা নির্বাচন। কারণ নিরঙ্কুশ অর্থে সামান্যতম-তিল পরিমাণ কোনো অনিয়ম হবে না সেটা জোর দিয়ে কখনোই বলা যায় না।
‘আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় নির্বাচন ভণ্ডুল হয়ে গেছে, নির্বাচনের ফলাফল ভণ্ডুল হয়ে গেছে গণ অভ্যুত্থান বা সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে। যার ফলে আমাদের দেশে দীর্ঘস্থায়ী গণতন্ত্র—যেটা ভারতে আমরা লক্ষ করি, আমেরিকাতে আছে কিন্তু আমাদের এখানে গণতন্ত্রটা এখনো নিরবচ্ছিন্নভাবে ১০০-২০০ বছর চর্চিত হয়ে স্থিতিশীল অবস্থানে আসেনি,’ যোগ করেন তিনি।
হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘কিছুটা নির্বাচনী উত্তাপ হবে এবং কিছুটা গণ্ডগোল হতে পারে, কিছুটা সহিংসতা হতে পারে। এগুলো খুব বেশি ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না কিন্তু যেটা অসহনীয় সহিংসতা সেটা অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। অনেক জায়গায় ভোটাররা প্রশ্ন করেন, আমরা ভোট দিতে পারব তো? যে কোনো কারণেই হোক, একটা অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের ২০১৪ সালের নির্বাচনটা আগেই প্রতিরোধ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তার পরে সেই নির্বাচনটা ওভাবে সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি। সেখানে সহিংসতা হয়েছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনটা অংশগ্রহণমূলক হয়েছে এবং শান্তিপূর্ণ ছিল কিন্তু পরবর্তীতে সেই নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক উত্থাপিত হয়েছে। বিতর্কের অবস্থাটা আমরা জানি না কিন্তু জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক হয়নি—এটাই সত্য।’
তিনি বলেন, ‘পাবলিক পারসেপশন এমন একটি জিনিস; যদি একটা রং পারসেপশন গড়ে ওঠে, সেটিই সত্য পারসেপশন। সেটাই কারেক্ট পারসেপশন। কাজেই ইনকারেক্ট পারসেপশনও হতে দেওয়া যাবে না। আমাদের চেষ্টা করতে, যতদূর সম্ভব আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করে তুলতে হবে।’
বিচারকদের উদ্দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ হয়ে থাকে। আচরণবিধি ভঙ্গের একটা অপরাধ, যেটা এখন হচ্ছে। ছোট-বড় এখন কিছু কিছু অপরাধ হচ্ছে, সেটাও ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে এবং কিছু কিছু সহিংসতাও হচ্ছে। সহিংসতাকে কোনোভাবেই বরদাস্ত করা উচিত না, এটা জনগণের ভীতির সৃষ্টি করে। আমরা কখনো রক্ত দেখতে চাই না। মানুষকে আহত হওয়া দেখতে চাই না। সেগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছি।’
সর্বজনীনতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি অংশ নির্বাচন বর্জন করেছে এবং তারা শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনে বিপক্ষে বক্তব্য রাখছে। সাংবিধানিক মানদণ্ড অনুযায়ী অসুবিধা নেই, তারা জনমত সৃষ্টি করতে পারেন। সহিংস পন্থায় যদি এটার বিরুদ্ধাচরণ করা হয় বা যারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন তাদের যদি বাধা প্রদান করা হয় তাহলে অবশ্যই সংকট দেখা দেবে। সেই সংকট মোকাবিলা আমাদের করতে হবে। করতে হবে এই কারণে—আমাদের নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করতে হবে।
‘এখানে প্রতিরোধ আসতে পারে, বিপত্তি আসতে পারে। প্রতিহত করার চেষ্টা হতে পারে। তারপরও এই দায়িত্বটা আমাদের পালন করতে হবে,’ বলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
বিচারকদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, ‘ভোট কিন্তু অনুষ্ঠিত হয় কেন্দ্রে। একটি আসনে অনেকগুলো কেন্দ্র থাকতে পারে। কেন্দ্রর শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে যে কোনো মূল্যে। আমাদের দেশে নির্বাচনী সংস্কৃতি অতটা সমৃদ্ধ এখনো হয়নি; ভোট প্রক্রিয়ায় আমরা কারচুপির আশ্রয় গ্রহণ করার চেষ্টা করি, ভোটকেন্দ্র দখল করার চেষ্টা করি, পেশী শক্তি নিয়োগ করে থাকি, কালো টাকা বিতরণ করে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে থাকি। এই অপরাধগুলোকেও কিন্তু প্রতিরোধ করে ভোটটাকে জনগণের কাছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে।’