সপ্তম শ্রেণির পাঠবইয়ে ‘শরীফার গল্প’ থাকা পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে আসিফ মাহতাব উৎস ধ্বংসাত্মক কাজ করেছেন বলে মনে করছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।
স্প্রিং সেমিস্টারের প্রস্তুতিমূলক কাজে সময় ও প্রচেষ্টার জন্য খণ্ডকালীন এ শিক্ষককে পারিশ্রমিক দেয়া হবে বলে জানিয়েছে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।
‘সাম্প্রতিক ঘটনায় বিবৃতি’ শিরোনামে সোমবার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অফিস অফ কমিউনিকেশনস থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আসিফ মাহতাব উৎসের বই ছেঁড়ার বিষয়টি উল্লেখ করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি সব মত ও আদর্শের জন্য সহনশীলতা ও সম্মানের ভিত্তিতে গঠনমূলক আলোচনা, বিতর্ক এবং পারস্পরিক মতবিনিময়ে বিশ্বাস করে, কিন্তু ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জাতীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য আচরণ, যা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি সমর্থন করে না।
‘সাম্প্রতিক সময়ে জনাব আসিফ মাহতাব উৎস কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারের প্রকাশিত সপ্তম শ্রেণির জাতীয় পাঠ্যবইয়ের পৃষ্ঠা ছেঁড়া এবং পাবলিক ফোরামে অন্যদেরকে একই কাজ করতে বলার ঘটনাটিকে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি একটি ধ্বংসাত্মক কাজ বলে মনে করে এবং এ ধরনের অশিক্ষকসুলভ আচরণকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না।’
আসিফের সঙ্গে নতুন চুক্তি না করার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ‘এ কারণে ব্যাক ইউনিভার্সিটি ২০২৪ সালের স্প্রিং সেমিস্টারের জন্য জনাব আসিফ মাহতাব উৎসকে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নতুন চুক্তি না দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তবে ইউনিভার্সিটি জনাব মাহতাবকে এই সেমিস্টারের প্রস্তুতিমূলক কাজে তার সময় ও প্রচেষ্টার জন্য পারিশ্রমিক প্রদান করবে।’
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি সমকামিতার প্রচার-প্রসার করছে না উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি সকল ক্ষেত্রে দেশের সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং দেশের প্রচলিত বিধিবিধান মেনে চলার বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তাই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি সমকামিতার প্রচার ও প্রসারের সাথে যুক্ত—সামাজিকমাধ্যমে কিছু মহলের এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, তবে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি প্রত্যেকটি মানুষের সমান অধিকার এবং সম্ভাবনা বিকাশের পথে সমান সুযোগ সৃষ্টিতে বিশ্বাস করে।’
প্রেক্ষাপট
‘জাতীয় শিক্ষক ফোরাম’ নামের একটি সংস্থা গত ২০ জানুয়ারি জাতীয় সেমিনার আয়োজন করে। তাতে বক্তব্য দেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সাবেক খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস।
ওই সেমিনারে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ‘শরীফার গল্প’ অংশ থাকা পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে ফেলেন আসিফ, যিনি নিজেকে পরিচয় করিয়েছেন ইসলামি রাজনৈতিক দার্শনিক হিসেবে।
এর আগে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘এখন ভাই নতুন আইন প্রচারিত হচ্ছে আপনারা হয়তো বা জানেনও না। বাংলাদেশে আইন হবে যে যারা ট্রান্সজেন্ডার, যেসব ছেলে নিজেকে মেয়ে মনে করবে, তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়া হবে এবং এর বিরুদ্ধে আপনি যদি বলেন, আপনার এক বছরের জেল এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হবে।’
ওই সেমিনারে দেয়া বক্তব্যের একপর্যায়ে আসিফ বলেন, “আমি বেশি বক্তব্য দেব না। আমি জাস্ট একটু শেষ করে ফেলি তাড়াতাড়ি। শরিফ-শরিফার গল্প দিয়ে। দেখেন, এই যে গল্পটা, আমার কাছে বই। আমি কিনলাম। কেনার সময় আমার সাথে আশেপাশে যারা দেখছে, তারাও দেখে হাসি দিল। মজার বিষয়। এটা কী দিছে?
“এই যে লেখা আছে, ‘ছোটবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলত, কিন্তু আমি নিজেই একসময় বুঝলাম, আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে।’”
শরীফার গল্পের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘সে যদি মেয়ে হয়, একটা ছেলে যদি মেয়ে হয়, তাহলে তার বিয়ে হবে কার সাথে? ছেলের সাথে। তার মানে কী? সমকামী, যেটা আমাদের দেশে অবৈধ, কিন্তু সেটাকে বৈধ করা হচ্ছে এই গল্পের মাধ্যমে।’
ওই বক্তব্য দেয়ার এক দিন পর ২১ জানুয়ারি রাত ১১টা ৪৬ মিনিটে আসিফ ফেসবুকে নিজ অ্যাকাউন্টে এক স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘আজকে আমি ব্র্যাকে রেগুলার ক্লাস নিয়েছি। আমাকে এইমাত্র ফোন করে জানানো হয়েছে যে, আমি যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ক্লাস নিতে না যাই। আমি জানি না হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত তারা কেন নিল। আমাকে কোনো কারণ তারা দেয়নি।’
আসিফ মাহতাবের ওই স্ট্যাটাসের জেরে দেশজুড়ে ট্রান্সজেন্ডার, ‘শরীফার গল্প’, সমকামিতা ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্র্যাকের পণ্য বর্জনের ডাকও দেন অনেকে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২২ জানুয়ারি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আসিফ মাহতাব উৎস ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তার সঙ্গে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির কোনো চুক্তি নেই। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি তার কর্মী এবং তাদের চুক্তির গোপনীয়তা বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
একই তারিখে রাতে আসিফ মাহতাব ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘আমার কনট্রাক্ট যদি রিনিউ নাই করা হবে, তাহলে আমাকে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিটিং, কারিকুলাম ডেভেলপমেন্টের কাজ কেন করানো হলো?
‘সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার কোর্স রিনিউ করা হয়নি ভালো কথা। তো আমাকে দিয়ে একটা ক্লাস কেন নেওয়ানো হলো?’
এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলার মধ্যেই সোমবার নতুন করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কিছু মন্তব্য করার পাশাপাশি সর্বশেষ সিদ্ধান্তের কথা জানায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।
সূত্র: নিউজবাংলা২৪