Thursday, December 5, 2024

সর্বশেষ

আজ বিজয়ের দিন

আজ ১৬ ডিসেম্বর। আজ বাঙালির বীরত্ব ও আত্মদানের মহিমায় পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন, স্বাধীন এক রাষ্ট্রের মাথা উঁচু করে স্থান করে নেওয়ার দিন। এ দেশের সব মানুষের জাতীয় মুক্তির চেতনায় নতুন যাত্রা শুরুর দিন।

১৯৭১ সালে আজকের এই দিনে এই জনপদের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখর করে তুলে প্রত্যয় ঘোষণা করেছিল ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার’ মন্ত্রে পথ চলার। এদিন অবনত মস্তকে পায়ের কাছে আধুনিক সমরাস্ত্র নামিয়ে বাংলাদেশের জনগণের কাছে, বাংলাদেশ-ভারতের মিত্র বাহিনীর কাছে গ্লানিময় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তানের ঘাতক সামরিক বাহিনী। সারা বিশ্বের মানুষ বিহ্বল বিস্ময় নিয়ে দেখেছিল, রেসকোর্স ময়দানে (পরবর্তীকালে যার নাম হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পৃথিবীর অন্যতম সুপ্রশিক্ষিত, আধুনিক সব মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণ করছে কি না, বলতে গেলে খালি পায়ে, লুঙ্গি দিয়ে কাছা মেরে কেবল রাইফেল নিয়ে আত্মপ্রত্যয়ে জ্বলে ওঠা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। সেদিন আবারও চিরসত্য হয়ে জ্বলজ্বল করে ওঠে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পঙ্‌ক্তি : ‘সাবাস বাংলাদেশ/ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’

একাত্তরের সাতই মার্চে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার কালজয়ী ভাষণের মধ্য দিয়ে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্রে দীক্ষিত করেন। সেদিন তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে। ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তার এ সবুজ সংকেতেই জীবনকে তুচ্ছ করে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশের মানুষ। পঁচিশে মার্চের কালরাতে পৃথিবীর নৃশংসতম গণহত্যা চালিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পরও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পারেনি এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের সেই অপ্রতিহত গতি রুখতে। গণহত্যার শিকার লাখ লাখ মৃত মানুষের স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে তারা বরং দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ওঠে। দ্রুতই গড়ে ওঠে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকেন বটে, কিন্তু উপস্থিত থাকেন চেতনাজুড়ে।

একাত্তরের ১০ এপ্রিলেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বক্তৃতা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানিদের গণহত্যায় সন্ত্রস্ত দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, ‘প্রতিদিন আমাদের মুক্তিবাহিনীর শক্তি বেড়ে চলেছে। একদিকে যেমন হাজার হাজার মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিচ্ছে, তেমনি শত্রুর আত্মসমর্পণের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে।’ বিশ্ববাসীকে সেদিন তিনি জানিয়ে দেন, ‘স্বাধীনতার জন্য যে মূল্য আমরা দিয়েছি, তা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের উপরাষ্ট্র হবার জন্য নয়। পৃথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম একটি শান্তিকামী দেশ হিসেবে রাষ্ট্র পরিবারগোষ্ঠীতে উপযুক্ত স্থান আমাদের প্রাপ্য। এ অধিকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্মগত অধিকার।’ এ বক্তৃতার সাত দিনের মাথায় একাত্তরের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার তদানীন্তন মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার। পাশাপাশি এদিন অনুমোদন করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ও সর্বাধিনায়কত্বে, কর্নেল মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর সেনাপতিত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের লাল পতাকা ওড়ায় বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণ।

তবে বিজয়ের এই ৫২ বছরে এসেও চলার পথ এখনও মসৃণ নয় বাংলাদেশের। এখনও আমাদের এগোতে হচ্ছে নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটিতে সমাজ-অর্থনীতি নির্মাণ-পুনর্নির্মাণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে রুদ্ধ করে দেওয়া হয় স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথাতেই রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে সামরিক শাসনের জালে দেশকে আটকে ফেলে। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে এসে দেশ সামরিক শাসনের জাল থেকে মুক্ত হতে পেরেছে বটে, কিন্তু এখনও গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে অগণতান্ত্রিক শক্তির আস্ফালন, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের সংঘবদ্ধ অপতৎপরতা আমাদের রাজনীতিকে সংকটাপন্ন করে রেখেছে। এমন সব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বিশেষত গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটিয়েছে, উন্নীত হয়েছে মধ্যম আয়ের দেশে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ নানা দিক থেকে পিছিয়ে ছিল পাকিস্তান থেকে, কিন্তু এখন বিশ্বের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা, রাজনীতিবিদরা, পরিসংখ্যানবিদরা মুক্তকণ্ঠেই স্বীকার করছেন, পাকিস্তানকে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক সব সূচকেই পিছে ফেলে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।

আমরাও মুক্তকণ্ঠে বলতে চাই, সব প্রতিবন্ধকতাকে পরাস্ত করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে সামনের দিকে।

জাতির যে বীর সন্তানরা পরাধীনতার নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করতে জীবন দিয়েছেন তাদের গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে বিজয়ের এই দিনে আজ সকাল থেকেই রাজধানীর অদূরে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাবে সর্বস্তরের মানুষ। আজ সরকারি ছুটি থাকবে সারা দেশে। বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ বিশেষ বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, ‘লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে পরমতসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। তাই আসুন, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও চেতনা বাস্তবায়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরও বেশি অবদান রাখি, দেশ ও জাতিকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যাই, গড়ে তুলি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ- মহান বিজয় দিবসে এই আমার প্রত্যাশা।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত করেন, আর আমরা মাতৃভূমিকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিয়ে গেছি। স্বাধীনতার পর বিগত ৫২ বছরে আমাদের যা কিছু অর্জন তা জাতির পিতা এবং আওয়ামী লীগের হাত ধরেই হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশে পরিণত হবে, ইনশাল্লাহ।’

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হলো বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই অর্জনকে অর্থবহ করতে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সবাইকে জানতে ও জানাতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমরা পৌঁছে দেব। বিজয় দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

দিনটি উপলক্ষে দেশের সব সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান, সামরিক-বেসামরিক প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন, বিভিন্ন মসজিদে মিলাদ মাহফিল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিজয় দিবস উপলক্ষে দেশবাসীর মনে সৃষ্টি হয়েছে নতুন উদ্দীপনা।

সর্বশেষ

নির্বাচিত

Stay in touch

To be updated with all the latest news, offers and special announcements.