মানুষ সামাজিক জীব হলেও প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা বা একা থাকার প্রবণতা কম বেশি সবার মাঝেই লক্ষ করা যায়। আর যে কি না একা ভ্রমণ বা সোলো ট্রাভেলিং জীবনে একবার হলেও করেছেন, নিঃসন্দেহে এটি তার জীবনে সবচেয়ে আনন্দময় অভিজ্ঞতাগুলোর একটি হিসেবে মনের গভীরে দাগ কেটে থাকবে। তবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একজন ছেলের জন্য একা ভ্রমণ যতটা না সহজ, একজন মেয়ের জন্য ঠিক ততটাই কঠিন।
তবে সময়ের সাথে, মানসিক এবং সামাজিক সব বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসছেন নারীরা; বেরিয়ে পড়ছেন নতুন অভিজ্ঞতা খোঁজে। দেশে কিংবা বিদেশে, কোথাও বেড়াতে গেলে নারীরা সবার প্রথমে যেটা নিশ্চিত করেন তা হচ্ছে, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা। সে সব দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবকে এখন শীর্ষে রাখতেই হয়।
চলুন, সৌদিতে নারীদের জন্য সুরক্ষিত এবং দর্শনীয় এমন কয়েকটি স্থানের নাম এবং সেখানকার অভিজ্ঞতার বিস্তারিত তথ্যাদি জেনে নেই।
ঐতিহাসিক জেদ্দা
সৌদি আরবের প্রাচীন শহর জেদ্দা যেন আরবের বুকে এক লুকানো রত্ন। এটি পশ্চিম দিকে মক্কা থেকে মাত্র ঘণ্টাখানেক দূরে লোহিত সমুদ্রতীরে অবস্থিত। উপকূলীয় এই শহরটির আরেক নাম ‘মক্কার প্রবেশদ্বার’। অতীতের সব প্রাচীন বিস্ময় আর বর্তমানের জীবন্ত সংস্কৃতি যেন মিলেমিশে পথ চলছে জেদ্দায়। ইউনেস্কো স্বীকৃত সৌদির আটটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের একটি হিসেবে ২০১৪ সালে যুক্ত হয় জেদ্দা। এখানকার গোলকধাঁধার মতো ব্যস্ত রাস্তা থেকে সরু গলিগুলো ঘেরা চমৎকার প্রবাল-পাথরের দালানে। ‘রাওয়াশিন’ নামে পরিচিত বারান্দাগুলোর কাঠের জটিল নকশা। এখানকার প্রাচীন বাড়িগুলোর বেশিরভাগই আধুনিক আর্ট গ্যালারি কিংবা ক্যাফে।
এই বছরই ঐতিহাসিক জেদ্দায় একটি বুটিক হোটেল হিসেবে উদ্বোধন করা হয়েছে নাম, ‘বেইত জোখদার’। এক সময় সাধারণ জেদ্দাবাসীদের বসবাস ছিল এই বাড়িগুলোয়। প্রতিটি বাড়ি অত্যন্ত যত্ন সহকারে পুনরুদ্ধার করে পর্যটকদের বসবাসের উপযোগী করে তুলেছেন সেখানকার ইতিহাসবিদ, স্থানীয় শিল্পী, কারিগর এবং স্থপতিদের একটি দল। এখানকার অন-সাইট রেস্টুরেন্টে স্থানীয় সৌদি খাবারের স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন অতিথিরা। আর ছাদের বারান্দায় বিশ্রাম নিতে নিতে উপভোগ করতে পারবেন সুস্বাদু কফি।
পাথরের শহর হেগরা
মরুভূমি ঘেরা হেগরা শহরের অবস্থান সৌদি আরবের আল-উলা প্রদেশে। শহরটি তৈরি করেছিল আরবের প্রাচীন জনপদ নাবাতেনরা। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত সৌদির সর্ব প্রথম স্থান এটি। প্রায় ২ হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী এখানকার ১১১টি সমাধি। প্রতিটিতেই দেখা মিলে পাথরে খোদাই করা আরবীয় শিলালিপির নকশা। দিনভর ঐতিহাসিক নানান জায়গা চষে বেড়াতে পারবেন হেগরায়। রাউইস নামে পরিচিত, স্থানীয় গল্পকারদের থেকে শুনতে পারবেন নাবাতিয়ানদের গল্প। আল-উলার ওল্ড টাউনে ঘুরে দেখতে পারবেন হাজার বছরের পুরানো কাদামাটির ভবনের ধ্বংসাবশেষ।
এ বছর টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থানগুলোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে হেগরার ডার ট্যানটোরা হোটেল। এর অবস্থান, ওল্ড টাউনের সংস্কার করা একটি অংশে। ঐতিহ্যবাহী কাদামাটির কাঠামোকে ভেতরের দিক থেকে বুটিক স্টাইলের আবাসনে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
লোহিত সাগরের রাজ্য
৯০টিরও বেশি দ্বীপ ও দ্বীপপুঞ্জ, অপূর্ব সব সৈকতপ্রান্তর এবং ছোট-বড় নানা আকারের মরুভূমি টিলা, সব মিলিয়ে অপূর্ব রূপ সৌদির লোহিত সাগরের। এর তলদেশে ২৮ হাজার বর্গকিলোমিটার বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে রয়েছে লুকানো এক রাজ্য। গাঢ় নীল পানির গভীরে রঙিন এক বাস্তুতন্ত্রের বাস। সেখানে দেখা মিলে বিরল প্রজাতির প্রবালে ঘেরা প্রাচীর, সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং বিশাল পর্বতের গিরিখাত। এখানে হোটেলের নিজস্ব পুলতো পাবেনই, সাথে সত্যিকার অভিযান চাইলে অংশ নিতে পারেন সেইলিং, স্নরকেলিং, কায়াকিং, উইন্ডসার্ফিং এবং প্যাডেলবোর্ডিংয়ের মতো উত্তেজনাপূর্ণ বিভিন্ন জলক্রীড়ায়।
লোহিত সাগরের বুকে একটি নির্জন ব্যক্তিগত দ্বীপে অবস্থিত স্ট. রেজিস রেড সি রিসোর্ট। পানির ওপর বিলাসবহুল ভিলায় ঘেরা এই রিসোর্ট থেকে সরাসরি চলে যেতে পারবেন সেরা সব ডাইভিং স্পটগুলোতে। ডুবে বেড়াতে পারবেন স্বচ্ছ সমুদ্রের তলদেশ।
দিরিয়াহ
সৌদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাস্থল দিরিয়াহ, যার আরেক নাম ‘পৃথিবীর শহর’। শহরটি অবস্থিত রিয়াদে প্রদেশে। শহরটির কেন্দ্রে অবস্থিত ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত আত-তুরাইফ। জায়গাটিকে সৌদি সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর বলা হয়। এখানকার প্রতিটি কাঠামো নিজস্ব গল্প বলে; প্রতিফলিত করে প্রাচীন সৌদি সভ্যতার উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও সহনশীলতা, জীবনযাপন এবং সমাজ গড়ে তোলার গল্প। ঐতিহাসিক থেকে আধুনিক নানা ধরনের আরবীয় খাবারের স্বাদ নিতে চাইলে যেতে হবে, বুজাইরি টেরেসে। এখানকার দুইটি সাধারণ রেস্তোরাঁ, তকিয়া এবং মাইজ-এর কথা না বললেই নয়! স্থানীয় শিল্প ও নিদর্শনগুলো খুঁজে পাবেন গ্যালারিতে। ঐতিহাসিক আরবি ক্যালিগ্রাফি শিখে বিশেষ দিরিয়াহ ফন্টে লিখে নিতে পারেন আপনার নামও।
দিরিয়াহ ভ্রমণের সবচেয়ে মোক্ষম সময় শীতকাল। থাকার জন্য বেছে নিতে পারেন, দিরিয়াহ-এর সবচেয়ে সুপরিচিত স্থাপত্য কিংডম সেন্টারের ফোর সিজনস হোটেলে। এছাড়াও, নির্মাণাধীন আছে বাব সামহান নামে আরও একটি হোটেল।
নারীদের বিশেষ দল
রিয়াদ থেকে আল-উলা হয়ে জেদ্দার সফরে একা যেতে চাইলে যোগ দিতে পারেন নারীদের বিশেষ একটি দলে। সৌদির বিভিন্ন প্রাকৃতিক বৈচিত্র এবং ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট জুড়ে নারীদের জন্য একটি বিশেষ অভিজান চালু করেছে ইন্ট্রেপিড ট্রাভেলারস। সফরে আরবীয় ইতিহাসের পথ ধরে যেতে যেতে স্বাদ নিতে পারবেন মুখরোচক নানা খাবারের, পরিচিত হতে পারবেন স্থানীয় নারীদের সাথে। ঘুরে দেখতে পারবেন বিশেষ একটি লেবুর খামার, অংশ নিতে পারবেন রান্নার ক্লাসে।
এছাড়াও আছে মাটির পাত্র তৈরির কর্মশালা। স্থানীয় নারী গাইডরা শোনাবে শহরগুলোর গল্প। আর জেদ্দায় দেখা হবে সৌদির প্রথম নারী গাইডের সাথে। থাকবে নৌভ্রমণ ও স্নরকেলিং এর মত আনন্দময় সব ব্যবস্থা।
নির্দিষ্ট কোন পোশাকবিধি আছে কি?
অনেকেরই ধারণা, সৌদিতে ঘুরতে গেলেই পরতে হবে আবায়া। তবে সেটি ঠিক নয়। সময়ের সাথে সাথে সৌদি আরবে ফ্যাশনেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। তবে সৌদি নারীরা সাধারণত শালীন পোশাক পরেন, যেমন হাতাসহ টপস এবং হাঁটুর নিচ অব্দি স্কার্ট বা প্যান্ট। এ ধরনের পোশাক সূর্যের তাপ থেকে ত্বককে রক্ষা করে। লম্বা ঢিলেঢালা পোশাক, স্কার্ট, কার্ডিগান, ঢিলেঢালা সুতি শার্ট, লিনেন প্যান্ট, সানগ্লাস, সান হ্যাট, সানক্রিম এবং লিপ বাম সঙ্গে নিলেই চলবে।
পরিকল্পনা ও যাতায়াত
ঝামেলাহীন পরিকল্পনার জন্য সৌদি ট্যুরিজম অথরিটি স্বাস্থ্যসেবা, কল করার উপায় এবং প্রয়োজনীয় নম্বরসহ নানা প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে। সৌদি আরবে যাতায়াত বেশ নিরাপদ, সাশ্রয়ী এবং সহজ। ট্যাক্সি ছাড়াও রাইড-শেয়ারিং অ্যাপ উবার এবং কারিম সর্বত্রই পাওয়া যায়। আর নিজে গাড়ি চালাতে চাইলে হার্টজ, বাজেট বা এভিসের মতো কোম্পানির কাছ থেকে সহজেই গাড়ি ভাড়া নিতে পারেন। শুধু ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং ক্রেডিট কার্ড সাথে রাখতে হবে এবং বীমা কিনে নিতে হবে।