Sunday, September 7, 2025

সর্বশেষ

২২ বস্তিতে মাদকের আখড়া, ভাগ যায় পুলিশের পকেটেও

গাজীপুরের টঙ্গী বাজারসংলগ্ন হাজি মাজার বস্তি। ঢুকতেই দেখা গেল বাঁশ-টিনের তৈরি ছোট ছোট অসংখ্য ঘুপচি ঘর। একটা আরেকটার গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। সরকারি জমিতে গড়ে ওঠা এই বস্তি গাজীপুরে মাদক বিক্রির সবচেয়ে বড় আখড়া হিসেবে পরিচিত।

স্থানীয় বাসিন্দা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও গাজীপুরে মহানগর পুলিশের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, টঙ্গীর হাজি মাজার বস্তিসহ গাজীপুর মহানগরে ২২টি বস্তিতে বিক্রি হয় ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক।

অভিযোগ রয়েছে, এসব মাদক আখড়া থেকে পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ মাসোহারা পান। আওয়ামী লীগের পতনের আগে টঙ্গীর মাদক আখড়াগুলোর নিয়ন্ত্রণ করতেন তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের চাচা মতিউর রহমানের অনুসারীরা। এখন নিয়ন্ত্রণ গেছে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের কারও কারও কাছে। গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে মাদক কারবার আরও বিস্তৃত হয়েছে বলে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।

পুলিশের এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনেও এসেছে, বিভিন্ন থানার ওসি মাদক কারবারিদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায় করেন। যার ভাগ সেখানকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পকেটেও যায়।

প্রকৃতির বিপরীতে মানুষের সামান্য জ্ঞান ও প্রযুক্তি যে কতটা অসহায়, ক্রাকাতোয়া সেটি চমকপ্রদভাবে দেখিয়ে দিয়েছে।

বস্তিতে ঢুকতেই জেরা

প্রথম আলোর দুই প্রতিবেদক ১৪ আগস্ট সকালে সরেজমিনে যান টঙ্গীর হাজী মাজার বস্তিতে।

ওই বস্তিতে ঢোকার পর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। একপর্যায়ে বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ এসে ঘেরাও করেন। তাঁরা আক্রমণাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করে এই প্রতিবেদকদের বস্তি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। বের হওয়ার পর বস্তির বাইরের রাস্তায় আবার ঘিরে ধরেন একদল লোক। জানতে চান, বস্তিতে কেন আসা হলো। তাঁরা এ সময় প্রতিবেদকদের একজনের মুঠোফোন পরীক্ষা করে দেখেন কোনো ছবি বা ভিডিও করা হয়েছে কি না। পরে এই বস্তিতে আর না আসতে সতর্ক করে দেন তাঁরা।

সেখান থেকে বের হয়ে পাশের একটি বিপণিবিতানে গেলে সেখানকার এক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ‘মাদক কারবারিরাই আপনাদের ঘিইর‍্যা ধরছে। ওরা ওই বস্তিতে থাকে। ওরা ছিনতাইও করে।’

স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বস্তির ভেতরে যেসব ঘরে মাদক থাকে, সেসব ঘরের একটির সঙ্গে আরেকটির ভেতর দিয়ে যাতায়াতের পথ রয়েছে। অপরিচিতরা ঢুকতে গেলে জেরার মুখে পড়তে হয়। প্রবেশমুখগুলোতে মাদক কারবারিরা নজরদারির জন্য লোক রাখেন, যারা বস্তিতে ‘ওয়াচার’ নামে পরিচিত। এই বস্তি থেকে পাইকারি ও খুচরা দুইভাবেই মাদক বিক্রি হয়।

গণ-অভ্যুত্থানের পর টঙ্গী পূর্ব থানার বিএনপির সভাপতি সুমন সরকার এই বস্তির মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন বলে স্থানীয় ও পুলিশের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে। টঙ্গী পশ্চিম থানার সাবেক সভাপতি রাশেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হাজি মাজার বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন সিদ্দিকুর রহমান ওরফে ডুবলি। সিদ্দিকুর টঙ্গী পূর্ব থানা বিএনপির সভাপতি সুমন সরকারের লোক।

তবে সুমন সরকার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, মাদক কারবারের সঙ্গে তাঁর কোনো যুক্ততা নেই। সিদ্দিকুর রহমানও মাদক কারবারে জড়িত নন।

মাদকের আরেক বড় আখড়া এরশাদনগর বস্তি। এই বস্তিতে মাদক বেচাকেনায় খুব বেশি রাখডাক নেই। স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে কারও প্রতিবাদ করার সাহস নেই, প্রাণনাশের ভয় আছে। তাই আমরা শুধু দেখি, কিছু বলতে পারি না।’

গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি শওকত হোসেন সরকার মনে করেন, ‘পুলিশ সিরিয়াস হলে অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব না হলেও দমন করা সম্ভব।’ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসনকে শক্ত অবস্থান নিতে বলেছেন তিনি।

প্রকৃতির বিপরীতে মানুষের সামান্য জ্ঞান ও প্রযুক্তি যে কতটা অসহায়, ক্রাকাতোয়া সেটি চমকপ্রদভাবে দেখিয়ে দিয়েছে।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকায় মাদকের বিস্তারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে পুলিশের এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনেও। এতে বলা হয়, এ বিষয়ে থানার ওসিদের কোনো তদন্ত/তদারকি নেই। ওসিরা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোহারা আদায় করে থাকেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জিএমপি কমিশনার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওসিরা যদি টাকা নিয়ে থাকে তাহলে কোন ওসি কত নেন, সে বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরকে রিপোর্ট করতে বলেন। অথবা আমাকে রিপোর্ট দিক, তাহলে তদন্ত করে ওই ওসিকে সাসপেন্ড (সাময়িক বরখাস্ত) করে ব্যবস্থা নেব। এ রকম একজন কর্মকর্তার বিষয়ে অকাট্য সংবাদ না থাকলেও ইতিপূর্বে এর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়েছি।’

জিএমপির আরেকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মাদকের আখড়া থেকে উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগে চারজনকে এর আগে বদলি করা হয়েছে।

পুলিশের ওই অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন বস্তি থেকে মাদক কারবারি আরফিনা বেগম ওরফে আরফিন প্রতি মাসে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা তোলেন। সে টাকা গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের ‘মূল ক্যাশিয়ার’ গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) পরিদর্শক মো. গোলাম মোস্তফা সংগ্রহ করেন।

তবে গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার নলেজে নেই। আমি জিএমপিতে পাঁচ মাস ছিলাম।’ তিনি বলেন, গত ঈদুল আজহার ১০-১৫ দিন আগে পুলিশ সদর দপ্তর তাঁকে প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে খাগড়াছড়িতে এপিবিএনে বদলি করে।

এখানে কারও প্রতিবাদ করার সাহস নেই, প্রাণনাশের ভয় আছে। তাই আমরা শুধু দেখি, কিছু বলতে পারি না।
স্থানীয় বাসিন্দা
গোলাম মোস্তফা জানান, জিএমপির কমিশনার নাজমুল করিম খান ও অতিরিক্ত কমিশনার জাহিদুল হাসানের সঙ্গে তিনি আগে চাকরি করেছিলেন, সে কারণে তাঁকে ‘রিকুইজিশন’ দিয়ে গাজীপুরে নেওয়া হয়েছিল।

মাদকের টাকার ভাগ পাওয়ার যে কথা এসেছে, তা নিয়ে জানতে চাইলে জিএমপি কমিশনার মো. নাজমুল করিম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই প্রতিবেদন তাঁকে দিলে তিনি বিষয়টি তদন্ত করাতে পারতেন। ওনারাও একটি তদন্ত কমিটি করতে পারতেন। এখানে আমি যদি অন্যায়ে জড়িত থাকি, আমার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’ কমিশনার বলেন, গাজীপুর মহানগরে মাদকের কারবারের পেছনে প্রভাবশালী দল রয়েছে।

পুলিশের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে যে আরফিনা বেগমের কথা এসেছে, তিনি টঙ্গীর ব্যাংকের মাঠ বস্তির মাদকের নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে টঙ্গী পূর্ব থানায় মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে।

টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আরেফিনাকে বহুবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আবার জামিনে মুক্ত হয়ে যান। এর মধ্যে কোনো কোনো মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, কোনো কোনো মামলার বিচারও শুরু হয়েছে। ওসির দাবি, আরফিনাকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে।

মাদক আখড়া থেকে মাসোহারা পাওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে ওসি ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘এসব অমূলক কথা।’ টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি ইস্কান্দার হাবিবুর রহমানও দাবি করেন, মাসোহারার বিষয়টি ভিত্তিহীন।

শিল্পনগরী গাজীপুরের বস্তিগুলো মাদক ও সন্ত্রাসের আখড়া বলে জানান গাজীপুর মহানগর জামায়াতের আমির মুহা. জামাল উদদীনও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কিছু সদস্য এবং রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানী নেতারাও এর সঙ্গে জড়িত।

২২ আখড়ায় অবাধে বিক্রি
জিএমপি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকা অনুযায়ী, ২২টি মাদকের আখড়ার মধ্যে আছে গাজীপুর মহানগরে। সেগুলো হলো কড়ইতলা বস্তি, কলাবাগান বস্তি, জিন্নাত মহল্লা বস্তি, নিশাত মহল্লা বস্তি, লাল মসজিদের পেছনের বস্তি, নামার মাজার বস্তি, ব্যাংগলের মাঠ বস্তি, মিল ব্যারাক বস্তি। আরও রয়েছে ব্যাংকের মাঠ বস্তি, টঙ্গী স্টেশন বস্তি, আমতলী কেরানীটেক বস্তি, এরশাদনগর বস্তি, গাছা বস্তি, লক্ষ্মীপুরা, শিববাড়ি রেলগেট বস্তি, বরান, কোনাবাড়ি, টঙ্গী বোর্ডবাজার, ভোগড়া, সালনা, পুবাইল ও কাশিমপুর কারাগারের পাশের বস্তি।

জিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) তাহেরুল হক চৌহান প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুর শিল্পনগরী ধরে বস্তি গড়ে উঠেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশ জোরালো অভিযান চালাতে পারছে না। আগে পুলিশকে মাদক কারবারি সন্ত্রাসীরা ভয় পেত। এখন তারা পুলিশকে গ্রাহ্য করতে চায় না। তবু প্রায় প্রতিদিন অভিযান চালিয়ে মাদক উদ্ধার ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

গ্রেপ্তার ও মাদক উদ্ধার
জিএমপি সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত গত সাত মাসে জিএমপির ৮ থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ৪৬৮টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় মোট ৭০৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় ১ লাখ ২৭ হাজার ২৪২টি ইয়াবা বড়ি, ২ হাজার ৪১ বোতল ফেনসিডিল, ৭৯৯ গ্রাম হেরোইন, ৫৮৮ কেস গাঁজা, ১০১ লিটার বিয়ার ও ৮০৬ লিটার বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়।

গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত গত এক বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গাজীপুর মেট্রো অঞ্চল মাদক মামলায় ৩৮৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১ লাখ ২৩ হাজার ৬৩৪টি ইয়াবা, ১ কেজি বেশি হেরোইন, ২৫১ বোতল ফেনসিডিল, ২০২টি ট্যাপেন্ডাডল ট্যাবলেট, ২৬৭ কেজি গাঁজা, ৩৩৫ লিটার চোলাই মদ ও ৪৬ ক্যান বিয়ার উদ্ধার করা হয়।

গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর গাজীপুরে মাদক বিক্রি হচ্ছে সবজির মতো। ফলে মাদকসেবীও বেড়ে গেছে।

গাজীপুরের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল রোববার কথা হয় সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) গাজীপুরের সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর গাজীপুরে মাদক বিক্রি হচ্ছে সবজির মতো। ফলে মাদকসেবীও বেড়ে গেছে।

ইফতেখার শিশিরের মতে, পুলিশ সদর দপ্তর ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সমন্বিত অভিযান চালিয়ে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

সূত্র: প্রথম আলো

সর্বশেষ

নির্বাচিত

Stay in touch

To be updated with all the latest news, offers and special announcements.