গাজা উপত্যকাজুড়ে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাতে গিয়ে মানসিকভাবে ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পড়ছে ইসরাইলের সুপ্রশিক্ষিত সেনারা। আর এটাই স্বাভাবিক, যখন কোন সেনা অন্যায়ভাবে নারী-পুরুষ এবং শিশুদের হত্যা করবে, তখন দেরিতে হলেও তার বিবেকের তাড়নায় বিদ্ধ হবে।
পৃথিবীর ইতিহাসের যত অন্যায় যুদ্ধ এবং আক্রমণ হয়েছে, তার প্রতিটিতেই রয়েছে সেনার মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার দীর্ঘ ইতিহাস। সেসব সেনারা আমেরিকার হয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নেন, তাদের অনেকেই শেষ জীবন কাটাতে হয়েছে পাগলা গরদে। কারণ সেই যুদ্ধ ছিলো অন্যায় ও একতরফা।
শুধু ভিয়েতনাম নয়, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বহুদেশে একইভাবে অন্যায় যুদ্ধে জড়িয়ে খেসারত দিতে হয়েছে মার্কিন সেনাদের। সেসব যুদ্ধের ময়দান থেকে প্রায়ই শিরোনামে আসতে একটি শব্দ। সেটি হলো- ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’। অর্থাৎ, শত্রুপক্ষের নয়, নিজ সেনাদের গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনাকেই উল্লেখ করা হতো ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’ হিসাবে। বিশেষ করে আফগানিস্তানে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটেছে।
এবার, গাজা উপত্যকায় চলমান হামাস-ইসরাইল যুদ্ধেও শিরোনাম হলো ‘ফ্রেন্ডলি ফায়ার’ শব্দটি। ইসরাইলি বাহিনী আইডিএফ জানিয়েছে, অক্টোবরের ২০ তারিখ থেকে গাজায় স্থল অভিযান চালানোর সময় এখন পর্যন্ত তাদের ২০ জন সেনা নিহত হয়েছে ফ্রেন্ডলি ফায়ারে।
আইডিএফ-কে উদ্ধৃত করে টাইমস অব ইসরাইল এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্রেন্ডলি ফায়ারে নিহতদের মধ্যে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারাও রয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ১৩ জনই মারা গেছেন একে অপরের গুলিতে, সাতজন মারা গেছেন দুর্ঘটনাক্রমে, এর মধ্যে সাঁজোয়া যান দুর্ঘটনাও রয়েছে।
আইডিএফ দাবি করছে, অক্টোবরের শেষ দিকে গাজাতে শুরু হওয়া তাদের স্থল অভিযানে এখন পর্যন্ত ১১৬ জন সেনা সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ২০ জনই প্রাণ হারিয়েছে নিজ সহকর্মীর গুলিতে। নিহতদের মধ্যে কয়েকজন পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাও রয়েছে বলে স্বীকার করেছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।
গাজায় যে ২০ ইসরাইলি সেনা সহকর্মীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন তাদের মধ্যে ১৩ জনকে গুলি করা হয়েছে শত্রুপক্ষের সদস্য ভেবে । ইসরাইলি বাহিনী ভেবেছিল তারা যাদেরকে গুলি করছে তারা ফিলিস্তিনি। কিন্তু হত্যার পর বুঝতে পারে তারা নিজেদের সেনাদেরকেই হত্যা করেছে।
ইসরাইলের সেনাবাহিনী বলছে, ফিলিস্তিনিদের আল-আকসা তুফান অভিযান শুরু হবার পর থেকে এ পর্যন্ত ৪৩৫ জন ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছে। তবে নিরপেক্ষ সূত্রগুলো বলছে, গাজায় হতাহত ইসরায়েলি সেনার সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করা হচ্ছে না। ইসরাইলের ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি।
ইসরাইলি দৈনিক ইয়েদিয়োত আহারোনোত কয়েক দিন আগে এক প্রতিবেদনে বলেছে, তারা সামরিক সূত্রগুলো থেকে নিশ্চিত হতে পেরেছে ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি ইসরাইলি সেনা আহত হয়েছে। এদের মধ্যে দুই হাজার পঙ্গু হয়ে গেছে।
আইডিএফ নিজেই জানিয়েছে, গাজায় যুদ্ধ করতে গিয়ে সেনারা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, মানসিকভাবে অবসাদে ভুগছে, অস্ত্রশস্ত্র চালানোর নিয়মকানুন ভুলে যাচ্ছে, নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করছে না। আর এসব কারণেই ফ্রেন্ডলি ফায়ারের মতো ঘটনাগুলো ঘটেছে।
এসব ঘটনার মধ্যে ইসরাইলের বিমান হামলা থেকে ছোঁড়া রকেট আর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে নিজেদের সেনারাই। ট্যাংকের গোলাবর্ষণ থেকে শুরু করে বন্দুক যুদ্ধের সময় নিজেদের সহকর্মীকেই মেরে ফেলেছে ইসরাইলি সেনারা। এমনি সাঁজোয়া যান চালানোর সময় দুর্ঘটনাতেও মারা গেছেন তিন ইসরাইলি সেনা।
এবার জেট ফুয়েলবাহী ট্যাংকারে হুতিদের মিসাইল হামলাএবার জেট ফুয়েলবাহী ট্যাংকারে হুতিদের মিসাইল হামলা
জেলেনস্কির সফরেও বদল নেই মার্কিন অচলাবস্থায়জেলেনস্কির সফরেও বদল নেই মার্কিন অচলাবস্থায়
আইডিএফ বলছে, ঘনবসতিপূর্ণ গাজা উপত্যকা, বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগের সমস্যা এবং সেনাদের ক্লান্ত হয়ে পড়া এবং সমরকৌশলে মনোযোগ না দেয়ার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু যুদ্ধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্য কথা। তাদের মধ্যে ফ্রেন্ডলি ফায়ারের পেছনে আরও কারণ আছে।
তারা বলছেন, গাজায় অভিযান শুরুর আগে হামাসের গেরিলা কৌশলের যুদ্ধে সম্পর্কে খুব কম তথ্যই ছিলো ইসরাইলের হাতে। এতোটা কঠিন প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হবে সেটা ধারণার বাইরে ছিলো। সেই সঙ্গে নিরীহ মানুষ ও শিশু হত্যার বিষয়টি মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইসরাইলি সেনাদের জন্য। আর এসব কারণেই নিজেরাই নিজেদেরকে মেরে দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে চাইছে ইসরাইলি সেনারা।